নিজস্ব বার্তা পরিবেশক।। সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে শনিবার (১৬ জুলাই, ২০২২) বিকেলে সারাদেশে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ডাকে আয়োজিত গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে দেশব্যাপী চলমান সাম্প্রদায়িক নির্যাতন-নিপীড়ন এবং শিক্ষকদের উপর হয়রানি বন্ধের জোর দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, এর অন্যথায় আগামি সংসদ নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে সংগঠন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আগামি ২২ অক্টোবর শনিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একই দাবিতে সারাদেশে গণঅনশনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
নিজ নিজ সংগঠনের পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনসমূহের হাজারো মানুষ এসমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠানের পর এক বিক্ষোভ মিছিল শ্লোগানসহকারে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ প্রদক্ষিণ করে। চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় চত্বরে সমাবেশ শেষে হাজারো জনতার মিছিল আন্দরকিল্লা, লালদীঘি হয়ে নিউমার্কেট চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।সমাবেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের ইতিমধ্যে সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে আজও সরকারের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। এতে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি হতাশ হয়ে সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এ আন্দোলনে নেমেছে। এছাড়া বিকল্পে আর কোন পথ তাদের সামনে খোলা নেই। তাঁরা বলেন, বিগত মার্চ মাসে আড়াই লক্ষ লোকের গণস্বাক্ষরসম্বলিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর অবগতির জন্যে তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়া সত্ত্বেও আজও কোন সরকারি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।নেতৃবৃন্দ সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, বৈষম্য বিলোপ আইন ও দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন; অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিগত সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার দলের প্রধান হিসেবে নিজেই ঘোষণা করেছিলেন। তাই তিনি স্বদ্যোগে তাঁর প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন বলে তঁাঁরা আশা প্রকাশ করেন।
নেতৃবৃন্দ দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠিকে ভয়াবহ বিপর্যয় ও ভবিষ্যত অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকারি দলে ‘কাউয়া’ ঢুকেছে। এসব কাউয়ারা শেখ হাসিনা সরকারের যা কিছু অর্জন তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এরা সরকারি দলকে জনবিচ্ছিন্ন করার জঘন্য চক্রান্তে তৎপর। এসব চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাঁরা সরকারি দলের নেতৃবৃন্দের কাছে আহ্বান জানান এবং বলেন, আগামি সংসদ নির্বাচনে তাদের যেন কোন দল থেকে প্রার্থী করা না হয়। ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ রাজনীতি যাতে গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরে আসে তজ্জন্যে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ মহানবীর প্রতি ভারতের জনৈক রাজনীতিবিদ নুপুর শর্মার কটাক্ষের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সকল ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষ এতে নিদারুণভাবে ক্ষুব্ধ। ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজ ধর্ম ও অপরাপর ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করতে পারে না। কারণ ধর্ম যার যার পবিত্র ব্যক্তিগত বিশ্বাস। নেতৃবৃন্দ তার জঘন্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতের জন্যে ভারত সরকারের কাছে ইতোমধ্যে দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা নুপুর শর্মার বিরুদ্ধে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের অতি সাম্প্রতিক মন্তব্যকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, কেউ যদি কোন ধর্ম সম্পর্কে কটুক্তি করে সে দায় তার নিজের। এ জন্যে তার সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় তুলে হামলা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর-বাণিজ্যিক কেন্দ্র-উপাসনালয় ভস্মিভূত করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। কিছুতেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নেতৃবৃন্দ মনে করেন, গোটা সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় তোলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টিকারীর দায় কোনভাবেই গ্রহণ করবে না, বরং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে নেতৃবৃন্দ জানান।
নেতৃবৃন্দ পবিত্র ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত না করার জন্যে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের বিষয় আর রাজনীতি হচ্ছে তর্ক-বিতর্কের বিষয়। ধর্ম তর্ক-বিতর্কের অনেক উর্ধ্বে। তাই ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় সকল ধর্মপ্রাণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে এবং নানান মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণেœ ধর্মনির্বিশেষ যারা তৎপর তাদের বিরুদ্ধে সচেতন ভূমিকা গ্রহণের জন্যে সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকার সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের অন্যতম সভাপতি সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও, সভাপতিম-লীর সদস্য এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, কাজল দেবনাথ, সাংবাদিক বাসুদেব ধর, এ্যাড. প্রিয়রঞ্জন দত্ত, রঞ্জন কর্মকার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ, জয়ন্ত কুমার দেব, এ্যাড. শ্যামল কুমার রায়, এ্যাড. কিশোর রঞ্জন ম-ল, রবীন্দ্র নাথ বসু, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ঐক্য পরিষদ মহানগর দক্ষিণের সভাপতি লায়ন চিত্ত রঞ্জন দাস, ঐক্য পরিষদ মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় শিশির, বাংলাদেশ খ্রিস্টান্ এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হেমন্ত কোড়াইয়া, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট (প্রভাস-পলাশ) নির্বাহী সচিব পলাশ কান্তি দে, বাংলাদেশ হিন্দু লীগের মহাসচিব শংকর সরকার, মাইনোরিটি রাইট ফোরাম বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. পবিত্র মিস্ত্রি, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট (সোনালী-এম রায়) সভাপতি ড. সোনালী দাশ, বাংলাদেশ ঋষি পঞ্চায়েত ফোরামের সভাপতি রামানন্দ দাশ, সনাতন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজু চৌধুরী, বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল, বাংলাদেশ আইনজীবী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ্যাড. বিভাস রঞ্জন বিশ্বাস, বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. অনুপ কুমার সাহা, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক কাজল চন্দ্র দাস প্রমুখ।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর হালদার।