Aims & Objects

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ: উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

(ঐক্য পরিষদের গঠনতন্ত্রের ৪ নং ধারায় বর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এখানে সংকলিত হল।)

ধারা ৪ : উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য-

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান নাগরিকদের ঐক্যবাহী একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি জাতীয়তাবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের স্বীকৃতি, সকল মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বৈষম্য-বঞ্চনা-সাম্প্রদায়িকতার অবসান, আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অনগ্রসর জনগনের উপর শোষণ-নির্যাতন-বৈষম্যের অবসান, সামাজিক স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমমর্যাদার ভিত্তিতে সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলাই হবে এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

পাকিস্তানী দ্বি-জাতিতত্ব, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা, স্বৈরাচার, শোষণ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন এবং যার চূড়ান্ত পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নজিরবিহীন ঐক্য ও সমতাবোধ গড়ে উঠেছিল এবং যা বাঙালী জাতিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, সে চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যেই এই সংগঠন কাজ চালিয়ে যাবে।

ঘোষণাপত্র :

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বার্থবাদী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদেশের সকল সম্প্রদায় ও সকল শ্রেণীর জনগণ সূচনা থেকেই রুখে দাঁড়ায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষময় ফলশ্রুতি-বিভেদ, অনৈক, হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা। এ প্রতিক্রিয়াশীল ধারার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বাঙ্গালী জাতি সত্তার বিকাশ ঘটে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টানের সম্মিলিত সংগ্রাম এক অপরাজেয় জাতি সত্তার মৃত্যুঞ্জয়ী প্রত্যয়ে রূপান্তর লাভ করে এবং ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। মুক্তি সংগ্রামের মূল চেতনা জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পরবর্তীকালে সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে রূপান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র জাতি উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদই বিভিন্ন ধর্মের সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন দ্বারা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যাত সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদ শক্তিকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। শাসক-গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রগতিশীল ধারাকে প্রতিহত করে স্বৈরশাসনকে চিরস্থায়ী করার জন্য পাকিস্তানী কায়দায় ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছে।

এসব বিভেদমূলক কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এ দেশের শতকরা ২০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় আড়াই কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ঠেলে দেয়া হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কর্মসংস্থানসহ জীবনের সকল বৈষয়িক ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নানা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। উপজাতীয় জনগণ আজ ন্যায় সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে এদের সবার মধ্যে জন্ম নিয়েছে নৈরাশ্য। অন্যদিকে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর সুযোগে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি এবং সমাজ বিরোধীদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন, জায়গা-জমি দখল, হয়রানী, অগ্নিসংযোগ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় যুবকদের সর্বহারা দলের কর্মী বলে চিহ্নিত করে পুলিশ গ্রেফতার করছে ও অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। তদুপরি তথাকথিক কাল্পনিক ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’র নামে বিভেদ, অনৈক্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু নেতৃস্থানীয় লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন এলাকায় ভিত্তিহীন অজুহাতে অগণিত লোক হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

আশার কথা, বীর বাঙ্গালী জাতি অতীতের মত আবারও সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ,ধর্মান্ধতা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সমগ্র দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও সর্বশ্রেণীর সচেতন নাগরিকবৃন্দ স্বৈরাচারী সরকারের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আওয়াজ তুলেছে- বাংলাদেশের মূলনীতি-বিরোধী রাষ্ট্র-ধর্মের অসাংবিধানিক বিধান প্রত্যাহার করতে হবে, পুণ: প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, আর বন্ধ করতে হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও বঞ্চনার বৈষম্যমূলক কর্মকান্ড।

এর প্রেক্ষিতে আমাদের দাবী :

১। সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর ধর্মীয় বৈষম্যমূলক অসাংবিধানিক ধারাবলী বাতিল কর। ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়- ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই।

২। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির আলোকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুণ:প্রতিষ্ঠা চাই।

৩। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিভাগ, সরকারী প্রশাসন, সরকার নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠানসহ সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় কর্মসংস্থান ও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে এবং শিল্প ও বাণিজ্যসহ জীবনের সকল বৈষয়িক ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার দিতে হবে।

৪। আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকদের নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অক্ষুণœরাখার অধিকারসহ সর্বপ্রকার ন্যায় সঙ্গত অধিকার দিতে হবে।

৫। কুখ্যাত অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বাতিল কর।

৬। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা প্রতিরোধ কর- ধর্মের ভিত্তিতে সকল বৈষম্য নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধ কর।

৭। তথাকথিত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার,নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ কর।

শ্লোগানে পরিচিতি :

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ নির্ধারিত শ্লোগানের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পন্থায় ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকারের আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। এ সব শ্লোগানে শান্তি, স্বাধীনতা, সমতা, মানবিক মর্যাদা ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আকাংখা-ই পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

শ্লোগানসমূহ :

ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার

যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে

ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই

সব সম্প্রদায় ভাই ভাই, বাঙালী হয়ে বাঁচতে চাই

এক দেশে দুই আইন, মানি না মানবো না

ধর্মের নামে জাতিভেদ, মানি না মানবো না

সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ, রুখে দাঁড়াও রুখতে হবে

ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে যারা, জাতি-ধর্মের শত্রু তারা

অমানবিকতার বিরুদ্ধে, লড়তে হবে এক সাথে

হিন্দু নয় মুসলিম নয়, আমরা সবাই বাঙালী

বৌদ্ধ নয় খ্রীষ্টান নয়, আমরা সবাই বাঙালী

আদিবাসী বাঙালী ভাই ভাই, এক সাথে দেশ গড়তে চাই

‘৭১ এর বীভৎসতা ভুলি নাই ভুলবো না

জাগো জাগো, বীর বাঙালী জাগো

‘৭২ এর সংবিধান, বাঙালীর প্রাণের দান

রাষ্ট্রীয়-ধর্ম আইন, মানি না মানবো না

সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যা, দিতে হবে দিতে হবে

আদিবাসী জনগনের ন্যায্য দাবী মেনে নাও

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কর, করতে হবে

বাঙ্গালী বাঙ্গালী ভাই ভাই, বাঙ্গালী হয়ে বাঁচতে চাই

বিভেদ-নীতি করে যারা, দেশ-ধর্মের শত্রু তারা

স্বাধীনতার শত্রুরা, হুঁশিয়ার সাবধান

মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার

সংখ্যালঘুদের উপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই

রক্তে কেনা স্বাধীনতা রক্ত দিয়েই রাখবো

রক্তার্জিত অধিকার ছিনিয়ে নিতে দেবো না

মানবাধিকারের আন্দোলন চলছেই চলবেই

মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তি, এক হও এক হও

বিভেদ না ঐক্য, ঐক্য ঐক্য

ঐক্যের সংগ্রাম চলছেই চলবেই

সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ, নিপাত যাক ধ্বংস হোক

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা

ধর্মে ধর্মে বিভেদ নাই, ধর্মব্যবসায়ীদের রক্ষা নাই

সব ধর্মের এই দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ

ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ কর, করতে হবে

সব সম্প্রদায় ভাই ভাই, জাত-ধর্মে বিভেদ নাই

হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান, এক জাতি এক প্রাণ

রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণা মানবাধিকারের লাঞ্ছনা

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি

সকল কালাকানুন বাতিল কর, মানবাধিকার রক্ষা কর

ধর্মীয় আবরণে সংবিধান মানি না মানবো না

সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ চলছে কেন, সরকার জবাব চাই

ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান চাই, সাম্প্রদায়িকতামুক্