বাঙালিরা রক্ত ঝরাইয়া বিশ্বদরবারে নিজ ভাষার অবস্থান দৃঢ় করিলেও এবং পরবর্তী সময়ে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিলেও, খোদ বাংলাদেশেই অন্যান্য ভাষা ক্রমশ বিপন্ন হইয়া পড়িতেছে। বিশেষত বাংলা ভাষার দাপটে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়িয়াছে। কিছু গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও লিপি রহিয়াছে, কাহারও বা ভাষা রহিয়াছে কিন্তু লিপি নাই। কোনো কোনো ভাষার অস্তিত্ব কেবল মৌখিক রূপেই বিদ্যমান। তবে প্রায় সকল ভাষার ভিতরেই বাংলার অনুপ্রবেশ ঘটিতেছে। জীবিকা ও জীবনের প্রয়োজনে নূতন প্রজন্মের অনেকেই নিজস্ব ভাষার স্থলে বাংলা ব্যবহারে অধিক উত্সাহী।
চাকমা ভাষার সাহিত্য রহিয়াছে, কিন্তু সামান্য কিছু লোকই উহা ব্যবহার করিয়া থাকে। চাকমা ভাষার অবশ্য কম্পিউটারভিত্তিক ফন্ট ও ইন্টারনেটভিত্তিক ইউনিকোড ফন্ট উদ্ভাবিত হইয়াছে। বাংলার পর ইহা দ্বিতীয় লিপি যাহা দ্বারা ইন্টারনেটে টেক্সট ব্যবহার বা সামাজিক মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করা সম্ভব হইতেছে। ত্রিপুরা, বম, খুমী, পাংখো ও লুসাই সমপ্রদায় রোমান হরফ ব্যবহার করিয়া থাকে। ১৯৮৫ সালে ম্রোদের হরফ প্রবর্তিত হইয়াছে এবং ১৯৮৬-৮৭ সালে ম্রো ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র চালু হইয়াছে। ইহা ছাড়া বার্মিজ বর্ণমালার আদলে চাক বর্ণমালা তৈরী হইয়াছে, যাহা এখনো পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে নাই। তবে ওঁরাও, সাঁওতাল, মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া, গারো এই রকম কয়েকটি নৃগোষ্ঠীর একক একটি ভাষা নাই।
যেকোনো ভাষা ও সংস্কৃতি পুরা পৃথিবীরই একেকটি অনন্য সম্পদ। ইহা মানব জাতির বৈচিত্র্য ও বৈভবকে নির্দেশ করে। কিন্তু দুনিয়াজোড়া সংখ্যাগুরুর জয়জয়কার, সংখ্যালঘু ক্রমশ হইয়া পড়ে কোণঠাসা। তাই বৈচিত্র্য ও বৈভবকে বাঁচাইয়া রাখিবার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর ঘাড়েই বর্তায়। আবার সংখ্যালঘুর দায়িত্বও এইখানে কম নহে। নিজের ভাষাকে বাঁচাইতে তাহাদের নিজেদেরও সচেষ্ট হইতে হইবে। বাহিরের শক্তি, সরকার বা বেসরকারি সংস্থা আসিয়া সব সংরক্ষণ করিবে, এমন আশা করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। একজন ম্রো উদ্যোগী হইয়া ম্রো হরফের প্রবর্তন করিয়াছেন। আবার একজন চাকমাই চাকমা ফন্ট প্রবর্তন করিয়াছেন। বাকি নৃগোষ্ঠীর মানুষদেরও নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাইয়া রাখিতে আগাইয়া আসিতে হইবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলিকে রক্ষা করিতে হইলে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশুনা করিবার সুযোগ দিতে হইবে। আবার সকল নৃ-ভাষার একটি সমন্বিত জরিপ বা গবেষণাও প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন, যাহাতে সেই ভাষাগুলির কী পরিস্থিতি বিরাজ করিতেছে তাহার একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।
তবে সরকার বিলম্বে হইলেও কিছু উদ্যোগ নিয়াছে। বিশেষত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট গঠিত হইবার পর হইতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা লইয়া কাজ করিবার কিছু সুযোগ তৈরি হইয়াছে। প্রণীত হইয়াছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট আইন, ২০১০’। নবম সংসদীয় সরকারের আমলেই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাদরি ও সাঁওতাল ভাষায় ২০১৪ সাল হইতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করিবার কথা থাকিলেও উল্লিখিত ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি না হওয়ায় এই কার্যক্রম শুরু করা যায় নাই। এই প্রকল্পের আওতায় ছয়টি ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা থাকিলেও সাঁওতাল ভাষায় হরফ ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক থাকায় সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমটি আপাতত স্থগিত রাখিয়া বাকি পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ চলছে। এই লক্ষ্যে সরকারিভাবে পাঁচটি লেখক কমিটিও গঠিত হইয়াছে। তবে এই বছরে এই শিক্ষা কার্যক্রম চালু হইবার কথা থাকিলেও, তাহা আর হইতেছে না। সরকার আগামী মার্চ মাসে বাংলাদেশে নৃ-ভাষার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা নামে একটি জরিপকার্য শুরু করিতে যাইতেছে। এই জরিপটি সম্পন্ন হইলে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাইবে এবং ভাষাগুলির পরিচর্যা করিবার কার্যকর সিদ্ধান্ত লওয়া সম্ভব হইবে।