দেশজুড়ে একের পর এক ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ ভিন্নমতাবলম্বী খুন হওয়ায় মাগুরার গ্রামগুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পুণ্যার্থী উপস্থিতি উল্লোখযোগ্য হারে কমে গেছে। সমস্যা সমাধানে মাগুরা পুলিশ সুপারের (এসপি) উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে চলছে প্রতিরক্ষা দল গঠন কর্মসূচি। রাত জেগে মানুষ গ্রাম পাহারা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে এর সুফল পাওয়া গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় গ্রামবাসীর হাতে জনপ্রতি একটি করে বাঁঁশের লাঠি ও বাঁশি দিয়ে গঠন করা হচ্ছে এই দল। গতকাল মঙ্গলবার সদর উপজেলার হাজরাপুর ও শ্রীপুরের বরিষাট গ্রামে এ ধরনের দুটি প্রতিরক্ষা দল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া গত রবি ও সোমবার সদর উপজেলার গোপীনাথপুর, টেঙ্গাখালী বাজার, শালিখা উপজেলার তালখড়ি লোকনাথ আশ্রম, গঙ্গারামপুর বালিকা বিদ্যালয় এলাকা, সদরের রামনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এলাকা, সাতদোহা ন্যাংটা বাবার আশ্রম, মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর সদর ও মহম্মদপুর উপজেলা সদর বাজারে আটটি প্রতিরক্ষা দল গঠন করা হয়েছে। গতকালের অনুষ্ঠানে এসপি প্রধান অতিথি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামবাসীর হাতে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি তুলে দেন। এ সময় অতিরিক্তি পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম, বিভিন্ন থানার ওসি, সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, শিক্ষক, সামাজিক নেতা, মন্দিরের পুরোহিত-সেবায়েতসহ সাধারণ গ্রামবাসী উপস্থিত ছিল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাশের জেলা ঝিনাইদহে গত ছয় মাসে ভিন্নমতাবলম্বী তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে হিন্দু পুরোহিত (আনন্দ গোপাল), শিয়া (আব্দুর রাজ্জাক) ও ধর্মান্তরিত (ছামির আলী) ব্যক্তি রয়েছেন। এ ছাড়া গত দুই বছরে একই কায়দায় সারা দেশে ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাগুরা জেলায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। তাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা বেশি। একের পর এক খুনের পর স্থানীয় মন্দিরগুলোতে উপস্থিতি একেবারে কমে যায়। সংকট কাটাতে গত ৯ জুন জেলার বিভিন্ন মন্দিরের পুরোহিতদের নিরাপত্তা নিয়ে মতবিনিময় সভা ডাকেন এসপি। সেখানে গ্রামে গ্রামে নিরাপত্তা বলয় গড়ার সুপারিশ উঠে আসে। সুপারিশের আলোকে এসপি এই লাঠি-বাঁশির প্রতিরক্ষা দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলার বরিষাট গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘সারা দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমরা কেউই নিরাপদ নই। এ কারণে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদেরই নিতে হবে।’ মাগুরা সদরের টেঙ্গাখালী মন্দিরের পুরোহিত নৃপেণ চক্রবর্তী বলেন, ‘এলাকায় রাতে প্রতিরক্ষা দলের পাহারা চালু হওয়ার পর বেশ নিরাপদ অনুভব করছি।’ সদর উপজেলার আঠারোখাদা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সঞ্জীবন বিশ্বাস বলেন, ‘আমার এলাকায় ৫০ শতাংশের বেশি হিন্দু। আতঙ্কও আছে। এ কারণে আমি পুলিশের সহযোগিতায় সব এলাকায় এ ধরনের দল গঠন করব।’ মাগুরা সদর থানার ওসি আজমল হুদা বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নয়, আমাদের টার্গেট প্রতিটি গ্রামে ১৫-২০ জনের সমন্বয়ে একটি করে প্রতিরক্ষা দল গঠন করা। প্রতি গ্রামে সম্ভব না হলে প্রথম দফায় অন্তত ৩৬টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে দল গঠন করা।’ মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি কিছু গুপ্তহত্যায় সর্বত্র যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে জেলাবাসীর মধ্য মনে সাহস বাড়ানোর জন্য এ পদক্ষেপ। এখানে শুধু সংখ্যালঘু নয়, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, পেশাজীবী, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সব মানুষকে একত্র করে প্রতিরোধ গড়া।’ বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মাগুরা জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব কুণ্ডু বলেন, ‘একটি কুচক্রি মহল দেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি আমাদের পাশের জেলা ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মের পুরোহিত ও খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হত্যা করেছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত। এই প্রেক্ষাপটে মাগুরায় বাঁশের লাঠি ও বাঁশি দিয়ে যে প্রতিরক্ষা দল গঠিত হচ্ছে তা ইতিমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ জন্য আমরা এসপিকে ধন্যবাদ জানাই। এটি সর্বজনীন নিরাপত্তার পাশাপাশি জেলায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে অন্য রকম সাহস জোগাচ্ছে।’ মাগুরার এসপি এ কে এম এহসান উল্লাহ বলেন, ‘পুলিশে জনবল সংকট রয়েছে। টার্গেট কিলিং (উদ্দেশ্যমূলক খুন) ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রুখতে জনতার পাহারা অত্যন্ত কার্যকরী হবে। দল গঠনের পর প্রতিটি গ্রামে মানুষ এক ধরনের নিরাপত্তা অনুভব করছে।