Background

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট

১৯৪৭-এ অবিভক্ত ভারত হতে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের দু’টি প্রদেশ, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব। এই দূরত্ব কি শুধু মাইলের? উত্তর পেতে সময় লেগেছিল মাত্র একটি বছর। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল ছাত্রসমাজ। সাথে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল সচেতন নাগরিক। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিল বাঙালি, যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিল উত্থাপন করেন তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ‘৫২ হতে ’৭১-ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং  স্বাধীনতা। পৃথিবীর বুকে নতুন মানচিত্র। নতুন লাল সবুজ পতাকা।  “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। এর পূর্বের ইতিহাস অবিভক্ত ভারত হতে দখলদার ইংরেজ হটাও আন্দোলন। এই দীর্ঘ পথে এ ভূখন্ডের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধারাবাহিকভাবে দেশ ও জাতির প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সন্ধিক্ষণে আপামর জনগণের মুক্তি ও প্রগতির পক্ষে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে।

ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাঙালি-বিরোধী শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় এক আধুনিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর প্রণীত হয় বাঙালির স্বপ্নলালিত সংবিধান যার প্রস্তাবনায় ছিল “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” একই সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ৮(১) ধারায় বিধৃত ছিল “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।” ধর্মের নামে অধর্ম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করা হবে না। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ও কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছিল ১২ নং অনুচ্ছেদে।
যাতে লিপি ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য :
ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা
খ) রাষ্ট্র   কর্তৃক   কোন   ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান
গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার
ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

এছাড়াও মৌলিক অধিকার ও সংগঠনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে শর্ত ছিল ধর্মের নামে রাজনীতি বিলোপ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং ওই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কোনো সাম্প্রদায়িক বা ধর্মভিত্তিক সংঘ বা সমিতি গঠন করা যাবে না যা ৩৮ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিল এভাবে “জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।” অর্থাৎ ধর্ম এবং রাষ্ট্র ’৭২-এর সংবিধানে মূল্যায়িত হয়েছিল পৃথক সত্তায়।

পক্ষান্তরে ১৯৭৫ এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর ১৯৭৮ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রারম্ভে প্রস্তাবনার ওপরে সন্নিবেশিত হয়েছে “বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহের নামে)”। প্রস্তাবনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নির্বাসিত হয়ে সংযোজিত হয়েছে, “সর্ব-শক্তিমান আল্লাহের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি। ধর্মের নামে রাজনীতি বিলোপ এই অবস্থান হতে সংবিধান যে শুধু সরেই এসেছে তা নয়, সংবিধান হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে ১২ নং অনুচ্ছেদ। এছাড়াও সংযোজিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়নে রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করতে সচেষ্টা থাকবে।

এই অবস্থান হতে আরও একধাপ এগিয়ে ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনের মাধ্যম সংবিধানে সংযোজিত হয় নতুন অনুচ্ছেদ “রাষ্ট্রধর্ম। ২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।” এই অংশের ইংরেজি করা হয়েছে, “The state religion. 2A. The state religion of the Republic is Islam, but other religions may be practiced in peace and harmony in the Republic”  সংবিধানে সর্বত্র ইংরেজি অংশে shall শব্দটি ব্যবহৃত হলেও, লক্ষণীয় এই একটি মাত্র জায়গায় may ব্যবহৃত হয়েছে।

ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল ৭২টি। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর সেই ৭২টি আসন ছেড়ে মূলধারায় মিশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিশ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে “বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি এই মন্ত্রে অর্জিত বাংলাদেশ আবারো হলো ধর্মরাষ্ট্র। এই ধর্মরাষ্ট্রে ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সাংবিধানিকভাবে শুধুমাত্র সম-নাগরিক অধিকারের মর্যাদা থেকেই বিচ্যুত হলো না, তাদের উপর বৈষম্য, নিগৃহণ, নিপীড়ন চালানোর অধিকার প্রকারান্তরে সংবিধানে স্বীকৃতি পেল। এরই প্রতিবাদে, প্রতিরোধে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মতে সম-অধিকার, সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।