শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন ২০১৭ সালের পাঠ্যবই প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ইসলামি চিন্তাবিদদের একটা রক্ষণশীল অংশ ‘নিরীশ্বরবাদিতার’ অভিযোগ তুলে বাংলা বই থেকে ১৭টি কবিতা এবং গল্প প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
১ জানুয়ারি স্কুলে বইগুলো যখন বিতরণ করা হলো, দেখা গেল, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই ১৭টি কবিতা এবং গল্প উধাও হয়ে গেছে। আরও কিছু পরিবর্তনও আনা হলো: প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যে ‘ও’ বর্ণের পরিচয়ে ‘ওল’-এর পরিবর্তে ‘ওড়না’কে উপস্থাপন করা হলো, যা মূলত মুসলিম কিশোরীরা বয়ঃসন্ধির সময় থেকে ব্যবহার শুরু করে; এবং ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যে ভারতের হিন্দু-অধ্যুষিত একটি স্থানের ভ্রমণকাহিনির পরিবর্তে যুক্ত করা হলো মিসরের নীল নদ ভ্রমণের কাহিনি।
পরিবর্তনগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না করলেও কিছু বুদ্ধিজীবীর কাছে এগুলো ইসলামি মৌলবাদের দিকে সরকারের ধাবিত হওয়ার অশনিসংকেত বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কট্টরপন্থীদের সহিংসতা দমনে লড়াই করছে বাংলাদেশ। এ সময়ে কয়েকজন ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এদিকে, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে: হিজাব পরা নারীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও তুলনামূলক হারে বাড়ছে।
ধর্মীয় সংগঠনগুলোর হাত এখন পাঠ্যবই সম্পাদনায় পড়েছে, যার দাবি তারা বছরের পর বছর ধরে করে এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, সংগঠনগুলোর প্রভাব বাড়ছে, এমনকি আওয়ামী লীগের সময়েও, যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে জোর দাবি করে।
বাংলাদেশে এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তিত করে তুলছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ এবং পরবর্তী দশকগুলোয় নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এ দেশ।
এই আদর্শ বহু বছর ধরেই প্রতিরোধক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সীমান্ত ততটা সুরক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ক্রমশ বাড়তে থাকা বহুজাতিক জিহাদি নেটওয়ার্ক এ দেশে খুব একটা জায়গা পায়নি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে নিরীশ্বরবাদী ব্লগার ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর চরমপন্থীদের হামলার ঘটনা ঘটছে, বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা দ্রুত অপসারিত হচ্ছে।
২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন আর বেশি দূরে নেই। বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থায় ইসলামি সংগঠনগুলোর চাওয়া অগ্রাহ্য করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ, তারা সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত দক্ষ।
২০১৩ সালের এক জমায়েত থেকে প্রথম পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের দাবি জানায় ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত গিয়েছি। সরকার বুঝতে পেরেছে, হ্যাঁ, মুসলিমদের এসব শেখা উচিত নয়। কাজেই তারা সংশোধন করেছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই হয়েছে এবং কারও অনুরোধে তা করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যদি হেফাজত দাবি করে থাকে যে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, তাহলে এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
এনসিটিবির সামনে কয়েক শ শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ করেছেন। তবে এই পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি, যারা আওয়ামী লীগের যেকোনো বিতর্কিত পদক্ষেপেই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের মধ্যে দারুণ ঐক্য হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্রে লোকরঞ্জনবাদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়।’
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে বিভেদ ২০১৩ সালে হঠাৎ করেই প্রকট হয়ে ওঠে, যখন হাজার হাজার লোক—এদের বেশির ভাগ মাদ্রাসার ছাত্র, রাজধানী ঢাকায় সমবেত হয়। তাদের দাবির তালিকায় ছিল, ‘নিরীশ্বরবাদী ব্লগারদের’ শাস্তি দিতে হবে, ভাস্কর্যগুলো ধ্বংস করতে হবে, পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনাসহ ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সতর্ক হয়ে সরকার শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করে। ২০১৪ সালের শুরুতে দেশের ১০ হাজার সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার প্রণীত পাঠ্যবই পড়ানো অত্যাবশ্যক করা হয়। আশা ছিল, এতে করে শিশু-কিশোরেরা রক্ষণশীল পটভূমি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
মাদ্রাসায় সরকার প্রণীত পাঠ্যবই পড়ানোর যে প্রচেষ্টা, তা বাস্তবায়নে নেতৃত্বদানকারী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষার দিকে নিয়ে যাওয়া।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস, চিন্তা এবং মনোভাবে বিস্তর ফারাক ছিল। আমরা সড়কে নেমে মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। এটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।’
শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত সুপারিশে মাদ্রাসার নেতারা অনুরোধ করেন, মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে হিন্দু, খ্রিষ্টান বা বিদেশি বলে মনে হয় এমন নামের পরিবর্তে ‘সুন্দর ইসলামি নাম’ ব্যবহার করতে হবে। ‘এটা একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাস্তব অধিকার’ বলে ওই সুপারিশে মন্তব্য করা হয়। পাঠ্যবই থেকে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যেকোনো ধরনের সংলাপ প্রত্যাহারেরও সুপারিশ করা হয়। তাঁদের মন্তব্য ছিল, ‘কোনো কারণ ছাড়া একজন মেয়ের সঙ্গে কথা বলা ইসলামের দৃষ্টিতে মহা পাপ।’
কর্তৃপক্ষও স্পষ্টত অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে উঠল। মাদ্রাসায় ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে হিন্দু, খ্রিষ্টান বা বিদেশি বলে মনে হওয়া সব ধরনের নাম বাদ দিয়ে সেখানে মুসলিম নাম লেখা হলো। ছেলেমেয়ের সংলাপ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। মাথায় কাপড় ছাড়া মেয়েদের ছবিগুলো সম্পাদনা করা হয়। মেয়েদের শারীরিক উন্নতির অধ্যায় থেকে ‘মাসিক’ শব্দটি মুছে ফেলা হয়। এনসিটিবির চেয়ারম্যান, যিনি একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী অধ্যাপক, তাঁর নাম ঊহ্য রাখা হয়।
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ওই সব বিষয়ে সরকার খুব একটা নমনীয় ছিল না। আমি মনে করি, ভালো কিছু করতে হলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়।’
কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যেসব কর্মকর্তা সম্পাদনার কাজগুলো দেখাশোনা করছিলেন, তাঁরা প্রথমে হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭টি কবিতা ও গল্প পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। দেশের ২০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসায় এই বইগুলো পড়ানো হয়।
হেফাজতে ইসলামের মুফতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘সরকার যদি দাবি মেনে নিতে চায়, আমলাতন্ত্র খুব বেশি বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি। আমরা সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত গিয়েছি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ইসলামি সংগঠনগুলোর দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিল, তা পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, ‘কেউই এ ব্যাপারে জানত না। কেউই দায়িত্ব নিচ্ছে না। অভিভাবকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, “আমরা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের ঘরেই পড়ানো শুরু করব”?’
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের নেতারা আরও কিছু পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করতে চান। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহ ওয়াসেল বলেন, চারু ও কারুশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের জীবিত কোনো কিছুর চিত্রাঙ্কন শেখানো উচিত হবে না। কারণ, ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। এর পরিবর্তে লিপিবিদ্যা শেখানো উচিত।
ফয়েজ উল্লাহ বলেন, শারীরিক শিক্ষার যেসব পাঠ্যবইয়ে মেয়েদের ব্যায়ামের ছবি আছে, সেগুলোও বাতিল চায় তাঁদের সংগঠন। তিনি বলেন, ‘ছেলেরা যা করে, মেয়েরা তা করতে পারে না। আমি গাছে চড়তে পারি, কিন্তু আমার স্ত্রী-বোন তা করতে পারবে না। মেয়েদের শারীরিক কসরতের ছবির প্রয়োজন নেই।’ তবে তিনি বলেন, তাঁদের লক্ষ্য পাঠ্যবইকে ছাপিয়ে আরও বড় কিছু। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই শিক্ষা কার্যক্রমে ছেলে ও মেয়েদের পুরোপুরি আলাদা করে দিতে চাপ সৃষ্টির আশা করছেন তিনি। ফয়েজ উল্লাহর মতে, ‘শ্রেণিকক্ষে ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে থাকতে দিলে তারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে উৎসাহিত হবে।’
ফয়েজ উল্লাহ বলেন, এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা থেকে শুরু করে বর্তমানের সব সদস্যকে পরিবর্তন করতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে হেফাজত। তিনি বলেন, ‘আমি প্রশ্নটা তুলতে চাই—এবং আমি তাঁর (নারায়ণ চন্দ্র সাহা) বিরুদ্ধে নই—তবে দেশে কি এমন কোনো মুসলিম ব্যক্তি নেই, যিনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারেন?’ তিনি বলেন, তাঁর সংগঠন অনুরোধ করেছে, নারায়ণ চন্দ্র সাহার পরিবর্তে এমন একজন ‘দেশপ্রেমিককে আনা হোক, যিনি বাংলাদেশের মানুষের অনুভূতি এবং আদর্শ বোঝেন’। ‘আপনি আমগাছ থেকে তো কাঁঠাল আশা করতে পারেন না।’ যোগ করেন তিনি।