সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ ও সামাজিক শক্তিকে সংহত করার লক্ষ্যে সোমবার ২৮ নভেম্বর বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধ করি, নতুন সমাজ নির্মাণ করি’-প্রতিপাদ্যর আলোকে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়োজনে জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
একটি নাচের মধ্য দিয়ে কনভেশন অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। লাভা বিশ্বাস নন্দিনী এবং পরিধি মজুমদার নাচ পরিবেশন করেন।
উক্ত কনভেনশনে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ. কে. রাশেদুল হক। ঘোষণা পাঠ করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
কনভেনশনে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় কমিটির সদস্য প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি-র ডিস্টিংগুইস ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন। নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এস এম এ সবুর, বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাড. আব্দুন নূর দুলাল, বিশিষ্ট সাংবাদিক বাসুদেব ধর, আইনজীবী অ্যাড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সাবেক সাংসদ ছবি বিশ্বাস, মনি সিংহ-ফরহাদ ট্রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পাদক মুকুল চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহবুব জামান, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাহিদা চৌধুরী, ডা. মেখলা সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানিয়া হক , বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক অ্ধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ।
কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম। মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
সভাপতির বক্তব্যে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন, নারীরা সামষ্টিকভাবে সমাজের জন্য কাজ করছেন। তাদেরকে বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে হবে। জাতিগঠনের জন্য পরিবারের মাধ্যমে, পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যবোধ কিভাবে তৈরি করা যায় এবিষয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের শেকড় পরিবার, সমাজ ও সংসারকে শক্তিশালী করতে এর বিকল্প নেই।
মডারেটরের বক্তব্যে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে নানা পদক্ষেপ থাকলেও সহিংসতার কারণ, উৎস বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট আলাদা । এর মূলে আছে সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে থাকা অসম ক্ষমতা। আমাদের দেশে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আজকের আয়োজিত কনভেশনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সমাজ মানস ও নারীর মানবাধিকার বিষয়ে জাতীয় কমিটির সদস্য প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, দেশের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা থাকলেও তার বিপরীতে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান চিত্র সমাজের নারী বিদ্বেষী মনোভাবকে প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় আলোচনায় বিজ্ঞান ভিত্তিক যা আলোচনা হয় তার চেয়ে বেশি থাকে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য। সমাজে একটা সহনশীল অবস্থা চলছে যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে, নারী পুরুষের বিভাজনে। এই পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি সকলকে সমাজ মানস পরিবর্তনে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, গণপরিসরে ধর্ষণ বর্তমান সময়ের সামাজিক ব্যাধি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, নতুন সমাজ নির্মাণে একটি বৈষম্যমুক্ত ও পিতৃতন্ত্রমুক্ত আইনকাঠামো তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত নারীবান্ধব আইনগুলোতে এখনো পিতৃতন্ত্রের ধারণা প্রবলভাবে রয়ে গেছে। প্রচলিত ধর্ষণের আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন আইন কাঠামো পরিবর্তন না করে ধর্ষণের সঠিক বিচার সম্ভব না। পাশাপাশি তিনি আরো বলেন, নারী ও কন্যা নির্যাতনের বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে; এজন্য মনিটরিং মেকানিজম নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক বরাদ্দবৃদ্ধি করতে হবে।
নারী ও কন্যার নিগ্রহ এবং সাইবার জগত বিষয়ে ড. কাবেরী গায়েন বলেন, প্রতি ১০ জনে একজন নারী সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সাইবার হয়রানির বিষয়ে এখনো অনেক নারী জানেন না। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে তিনি এসময় আইনি প্রয়োগের উপর জোর দেন।
নারী ও কন্যার মানবাধিকার ও অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ডিস্টিংগুইস ফেলো, সিপিডি বলেন, নারীর প্রতি হয়রানি কখন নির্যাতনে পরিণত হয় তা এখন তরুণদের আলোচনায় আসছে। বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের কারণে নারীও কন্যার প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। করোনায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে, ১০-২০% শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তারপর শিশুশ্রম বেড়েছে বাল্যবিয়ের পর বিচ্ছেদের কারণে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় বাড়লে নারীর প্রতি অভিঘাত বাড়বে। নতুন উন্নতির অংশীদারিত্বে নারীর অন্তর্ভূক্তি বৃদ্ধি না পেলে বৈষম্য বাড়বে। বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচির উন্নয়নে নারীর সাংস্কৃতিক, আইনি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানে নজর দিতে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ২৭ এবং ৪২ নং ধারা অনুযায়ী অভিন্ন পারিবারিক আইনে বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ ও দত্তক বিষয়কে কার্যকর করতে হলে সরকারকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। তিনি আজকের কনভেশনে উত্থাপিত সুপারিশসমূহ তুলে ধরে তার আলোকে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এস এম এ সবুর; লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক; শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ, সমাজকর্মী সালাউদ্দিন খান মঈন প্রমুখ।
উক্ত জাতীয় কনভেনশনে সংগঠনের কেন্দ্র ও ৪২ টি জেলা শাখার নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ এবং সংগঠনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।