নিজস্ব বার্তা পরিবেশক।। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার আন্দোলনের প্রেরণার উৎস মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত বীরউত্তমের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার (০২ সেপ্টেম্বর) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশ অনেক দূরে সরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একক সত্তা তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে বিভাজন এসেছে, তা হয়েছে ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে আপসের কারণে। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতাই এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুণ হাবীব, সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিত্রয় ঊষাতন তালুকদার, অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি সাংবাদিক বাসুদেব ধর ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রমেন মন্ডল। সঞ্চালনা করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. তাপস চন্দ্র পাল।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রয়াত জেনারেল দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, যাঁরা বংিলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করেছিলেন তাঁরা কেউ সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন না। তাঁরা সবাই ছিলেন জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রধর্মের কারণে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পরও সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকায় এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা- এ যেন সুকুমার রায়ের কবিতার হাঁস ও সজারু মিলে হাঁসজারু। বাহাত্তরের কথা বলে কালক্ষেপণ না করে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটকে কৌশলগতভাবে ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, এই ভোট নিয়েও আমরা কিছু করতে পারি না কেন ?
তবে তিনি বলেন, এবারের জনগণনায় অনেক সংখ্যালঘুকে হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছে। যেসব এলাকা হিন্দু প্রধান সেখানে হিন্দু সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে। ২০০৬ সালে শুনেছিলাম ৮১টি আসনে হিন্দু ভোট ফলাফল নির্ধারণ করে। অথচ এখন বলা হচ্ছে তা নয়, ৪৫টি আসন হিন্দু ভোট ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। ড. ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচন এলে মনোনয়ন পেতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। অথচ যারা নির্বাচিত হয়ে এলেন তারা প্রধানমন্ত্রী কিংবা জাতীয় সংসদে কি কখনো জানতে চেয়েছেন, হামলা-নির্যাতনের কেন বিচার হয় না ? তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে বাংলাভাষাভাষীদের বাইরে কাউকে স্বীকার করা হয়নি। এদের স্বীকার করে না নিলে দেশ এগুতে পারবে না।
হারুণ হাবীব বলেন, জেনারেল দত্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন, মনে-প্রাণে এই চেতনা লালন করতেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কর্মসূচিতে অংশ নিতে সারাদেশে ঘুরেছেন। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন ও আক্রমণ তিনি উপেক্ষা করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, বাঙালি কখনো পরাজিত হবে না, মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও জয়ী হবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সিনিয়রিটি সত্ত্বেও একমাত্র সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির কারণে জেনারেল দত্ত সেনাপ্রধান হতে পারেননি।
শ্যামল দত্ত বলেন, একাত্তরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ হয়েছিল। প্রাণ দিয়েছেন ত্রিশ লাখ মানুষ। নির্যাতিত হয়েছেন কয়েক লাখ নারী। দেশ পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তুপে। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে ? জেনারেল দত্তের আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের আামি দিনের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ৮ দশমিক ৯ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের কোনো মূল্য নেই। অথচ বড় দুই দলের ভোটের তফাত মাত্র ৪/৫ শতাংশ।
এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত বলেন, সরকারের ভেতরে আরেক সরকারের অস্তিত্ব আছে, আওয়ামী লীগের ভেতর আরেক দল আছে। ঘরে ঘরে সাম্প্রদায়িকতা আছে। মুক্তিযুদ্ধ আজ শৃংখলিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত। আমাদের নেতা জেনারেল সি আর দত্ত আমাদের বলতেন, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে, নইলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রে স্বপ্ন আমাদের সামনে আছে, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। দাশগুপ্ত বলেন, পার্লামেন্টে আমাদের লোক আছে, কিন্তু আমাদের কথা বলার লোক নেই। তারা নিজের এলাকায় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ান না। তাহলে সংসদে গিয়ে কী লাভ হচ্ছে। তিনি ড. দেবপ্রিয়র বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের মধ্যে হতাশা নেই, রাজনৈতিক আশ্রয় আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ১৯৪৭ থেকে হামলা, নির্যাতন ও জবরদখলের শিকার হতে হতে তাদের হতাশা গ্রাস করেছে। এখানে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ও নেই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা স্বপ্ন উঁকি দিলেও অচিরেই সে স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু আর আমরা বঞ্চিত হতে চাই না। জেনারেল দত্তের আদর্শ সামনে রেখে বলতে চাই, বাঁচতে চাই, বাঁচাতে চাই, দেশকে পঙ্কিলতার হাত থেকে মুক্ত করতে চাই।